মেহেদী হাসান:
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ— এখানে প্রতিটি ঋতু আসে নিজস্ব রূপ, রস ও গন্ধ নিয়ে।
ঠিক তেমনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (নোবিপ্রবি) ঋতুবৈচিত্র্যের এই জাদু ছুঁয়ে যায় প্রকৃতি ও মানুষকে। হেমন্তের বিদায়ের পরেই কুয়াশায় মোড়া শীতের আগমন ঘটে ক্যাম্পাসে।
চারদিকে সাদা কুয়াশার আস্তরণ, শিশিরভেজা ঘাস আর হিমেল হাওয়ায় নোবিপ্রবির প্রকৃতি যেন এক নতুন সাজে সেজে ওঠে।
ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই পুরো ক্যাম্পাস ঢেকে যায় ঘন কুয়াশায়। টুকিটাকি গোলচত্বর, শান্তিনিকেতন রোড কিংবা নীলদিঘির ধারে কিছুই যেন স্পষ্ট দেখা যায় না। তখন মনে হয়, প্রকৃতি এক রহস্যের পর্দা টেনে দিয়েছে নোবিপ্রবির উপর। একটু পরেই যখন সূর্যের কোমল আলো কুয়াশার পর্দা ভেদ করে আসে, তখন শিশিরবিন্দু ঝিলমিল করে ওঠে ঘাসের ডগায়। সে দৃশ্য যেন চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না— প্রকৃতির এমন মায়াময় রূপ শুধু নোবিপ্রবির শীতেই দেখা যায়।
শীতের আগমনের ঠিক আগেই ক্যাম্পাসে নামে এক মিষ্টি বৃষ্টি, যা যেন শীতের বার্তাবাহক। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ২০২৩–২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর হাসান সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,
“ক্যাম্পাসে শীতের আগে এই বৃষ্টি এক আশ্চর্য মুহূর্তের সৃষ্টি করেছে। মেঘের স্তর ভারী হয়ে আসা, আকাশে আলো হারিয়ে যাওয়া আর চারপাশে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা— সব মিলিয়ে এক অপার্থিব পরিবেশ। বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ যেন নোবিপ্রবির শান্ত পরিবেশে এক ভিন্ন আবহ এনে দিয়েছে। এই বৃষ্টি ঠিক যেন শীতের আগমনের পূর্বাভাস।”
ক্যাম্পাসে শীত মানেই এক আলাদা জীবনধারা। শিক্ষার্থীরা কেউ হুডি, কেউ চাদর জড়িয়ে সকালে ক্লাসে যায়; কেউবা নীলদিঘির পাড়ে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়। গায়ে হিমেল বাতাস লাগলেও তাদের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ। সকালবেলা ক্লাসের ঘণ্টা বাজার আগেই টুকটাক পায়ে হেঁটে যাওয়া, কুয়াশার মাঝে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া— এসব মুহূর্তই যেন ক্যাম্পাস জীবনের এক অন্যরকম রোমাঞ্চ যোগ করে।
শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে ফোটে নানারঙের ফুল। গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, তাজমহল, বিশ্বসুন্দরী, মোরগজুঁটি, জিনিয়া, দোপাটি, জুঁই, চামেলি, টগর ও জবা— এসব ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে নোবিপ্রবির প্রতিটি কোণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন এমনকি রাস্তার দু’পাশেও শোভা পায় এসব ফুল। যেন শীতের কুয়াশার মাঝে রঙধনুর ছোঁয়া এনে দেয় প্রকৃতি। ফুলের সৌরভে ভরে থাকে বাতাস, আর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে মুগ্ধ হয়ে তাকায় এ রঙিন দৃশ্যে।
নোবিপ্রবির বিভিন্ন স্থানে শীতের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে সমানভাবে। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে একাডেমিক ব্লক, আবাসিক হল কিংবা ক্যাফেটেরিয়া— সর্বত্রই দেখা মেলে শীতের মৃদু নীরবতা ও সৌন্দর্য। বিকেলের দিকে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে, তখন নীলদিঘির জলে তার প্রতিফলন রঙিন হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা কেউ ছবি তোলে, কেউবা বসে গল্প করে। পুরো ক্যাম্পাস তখন যেন শীতের মায়াবী আলোয় ঝলমল করে।
তবে নোবিপ্রবির শীত মানেই শুধু কুয়াশা আর ফুল নয়— এর সঙ্গে যুক্ত হয় অতিথি পাখির আগমনও। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আশ্রয় নেয় নোবিপ্রবির ময়না দ্বীপে। তাদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। কেউ কেউ বলে, এ যেন নোবিপ্রবির ‘প্রাকৃতিক সিম্ফনি’। সকালে যখন সূর্য ওঠে, তখন দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নীল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে; আবার কেউ শান্তভাবে জলে ভেসে থাকে।
এই অতিথি পাখিদের দেখতে প্রতি বছর ভিড় করে শিক্ষার্থী ও পাখিপ্রেমীরা। হাতে ক্যামেরা, চোখে বিস্ময়— সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের ওড়াওড়িতে। শিক্ষার্থীরা বলে, “শীত এলে মনে হয় ক্যাম্পাসটা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। অতিথি পাখিরা নোবিপ্রবির শীতকে করে তোলে আরও বিশেষ।”
প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থীরা আরো জানান, ময়না দ্বীপ এখন এক অনন্য পাখিবান্ধব অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানে আশ্রয় নেয় নানা প্রজাতির বুনোহাঁস, পানকৌড়ি, চখাচখি, গাঙচিল ও শামুকখোলের মতো অতিথি পাখি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এসব পাখির জন্য নিরাপদ পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট। ফলে প্রতি বছর পাখির সংখ্যা বাড়ছে, আর তার সঙ্গে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আগ্রহও।
শীতের সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডোবে, তখন ক্যাম্পাসের আকাশে উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। তাদের ডাক মিশে যায় দূরের আজানের সুরে। নোবিপ্রবির ছাত্রাবাসগুলোয় তখন জ্বলে ওঠে আলো, শুরু হয় রাতের ব্যস্ততা। দিনভর কুয়াশা, বিকেলে সোনালি আলো, আর রাতে টিমটিমে বাতি— সব মিলিয়ে নোবিপ্রবি হয়ে ওঠে এক জীবন্ত ছবির মতো।
এই শীত নোবিপ্রবিকে কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যে নয়, আবেগ ও স্মৃতির রঙেও ভরিয়ে তোলে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে যায় এই ঋতুর নরম উষ্ণতা। হয়তো একদিন তারা পেছনে ফিরে তাকালে মনে পড়বে— কুয়াশার চাদরে মোড়া সেই সকাল, নীলদিঘির পাড়ে গরম চা, ফুলের ঘ্রাণে ভরা পথ আর অতিথি পাখির ডাকে মুখর এক নোবিপ্রবি।
মেহেদী হাসান
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


