২ নভেম্বর, ২০২৫

শেকড়ে ফিরে যাওয়া-সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার 

শেকড়ে ফিরে যাওয়া-সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার 

শেকড়ে ফিরে যাওয়া ও সংক্ষিপ্ত পরিচিত 

সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া।। 
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনোনীত প্রার্থী, 
নোয়াখালী -২ (সেনবাগ -সোনাইমুড়ী আংশিক) আসন।

তথ্য সংগ্রহ :খোরশেদ আলম, সেনবাগ প্রতিনিধি।

অ্যালেক্স হ্যালি তার বিখ্যাত ’রুটস’ (শেকড়) গ্রন্থে বলেছিলেন “অতীতের সাথে সম্পর্কহীন মানুষ যেন শেকড় বিহীন গাছ”/ “A people without knowledge of their past are like a tree without roots.”

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার এক নিভৃত পল্লীগ্রাম পরিকোট-এ। কিন্তু শিক্ষা, কর্মের সংগ্রাম বহু মানুষের মতো আমাকেও শেকড়চ্যুত করেছিলো। এই শেকড়চ্যুতি আমার কখনো ভালো লাগেনি। বহু দিন, বহু বছর ধরে আমি শেকড়ে ফিরে যেতে চেয়েছি। মায়ায়, মমতায় ভরে থাকা আমার ছোটবেলার পল্লী গ্রামে...

আমার আত্মিক বন্ধন গ্রাম হলেও আমার রাজনৈতিক দর্শন সামষ্টিক, কালেক্টিভ। অর্থাৎ আমি সর্বতোভাবে মানুষকে সর্বাগ্রে রেখে, তাদের যূথস্বার্থের কথা ভেবে, তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি ও ক্ষমতায়নের জন্যই লড়াই করি। এই লড়াইয়ের অংশ হিসেবে, এই লড়াইকে বেগবান করতেই ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপির হাত ধরে আমার রাজনীতিতে পদার্পন। বৃহত্তর এই রাজনৈতিক আঙ্গিকে, চিন্তাচেতনায় আমার কাছে সামষ্টিক স্বার্থই সর্বাগ্রে, যার শুরু ‘মানুষ’ দিয়ে, তারপর নিজের দেশ ও অন্যান্য এবং সর্বশেষ কমিউনিটি দিয়ে। যার ফলে স্থানীয় রাজনীতি আমার কাছে প্রথাগত রাজনীতি নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা মানে আমার নিজের শেকড়ের সন্ধানে ফিরে আসা। এতে যতটা না রাজনীতি আছে তার চেয়ে বেশি আছে মাটির সোধা গন্ধ, মমতা, নিজের অস্তিত্বের আলো-বাতাসের সন্ধান... 

এই আলো-বাতাস, অক্সিজেনের খোঁজেই আমি গত ৩১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায়, স্থানীয় পর্যায়ে আমার রাজনৈতিক পদচারণা, প্রচারণা, কার্যক্রম শুরু করেছি। আমার শুরুটা স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় দিয়ে, তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে। তারপর আমি এনায়েতপুর ওয়ার্ডে স্থানীয় জনগণের সাথে একটি মতবিনিময় সভায় অংশ নেই এবং গণসংযোগ করি।

ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। এতদ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার ও গণমানুষের সামাজিক ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে আমার পূর্ব-পুরুষদের রয়েছে শত বছরের বেশি সংগ্রামের ঐতিহ্য। আমার প্রপিতামহ মরহুম আলাবক্স মজুমদার ১৯১৩ সালে সেনবাগের সবচেয়ে পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটির অন্যতম পরিকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয় অত্র অঞ্চলের লক্ষ-লক্ষ মানুষের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীতে আমার পিতামহ মরহুম অলিউল্যা মজুমদার একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হিসেবে কেশারপাড় ইউনিয়ন বোর্ড-এর (বর্তমান ১, ২, ও ৩ নং ইউনিয়ন এই বোর্ডের অধীনে ছিলো) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার বাবা গোলাম মর্তুজা মজুমদার ও বড় চাচা মরহুম মাস্টার মজিবুল হক মজুমদার সেনবাগ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদানে আমার পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকা ছিলো অবিস্মরণীয়। আমি তাঁদের গর্বিত উত্তরসূরি হতে পারবো কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করে যাবো। বাংলাদেশের রাজনীতি গত কয়েক দশকে যে অসুস্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, সেখানে রাজনীতির এই ম্যারাথনে টিকতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে জীবন সায়াহ্নে সাক্ষী দিতে পারবো, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ডাকে মাঠে নেমেছিলাম, পাশ্চাত্যের নিশ্চয়তার জীবন ছেড়ে। মহান সৃষ্টিকর্তা যেন উদগ্র ক্ষমতার লোভ, অহংকার ও রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি অর্জন থেকে নিজেকে হেফাজতে সামর্থ্য প্রদান করেন। 

আমার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

আমি সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া ইউনিয়নের পরিকোট গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার পরিকোট মজুমদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করি। পরিকোট গ্রামে আমার প্রপিতামহের প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী পরিকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। তারপর কানকিরহাট বহুমূখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে যোগদান করি। সেখান থেকে পরবর্তীতে গবেষণা স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ব্র্যান্ডাইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ে এমএ সম্পন্ন করি। বর্তমানে আমি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসন থেকে তুলনামূলক আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও বিশ্ব অধ্যয়ন নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করছি। 

আমি সুদীর্ঘ সময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক হিসেবে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে গবেষণা করেছি ও পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে একাধিক স্নাতকোত্তর কোর্স পড়িয়েছি। বিশ্বের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সচিবালয়ে আমি দক্ষিণ এশিয়া গবেষক হিসেবে ও পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির যুক্তরাষ্ট্র শাখায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রায় অর্ধ-যুগের বেশি সময় কাজ করেছি। এছাড়া আমি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করা ওয়াশিংটন-ভিত্তিক একাধিক থিংকট্যাংকের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছি, এবং ওয়াশিংটন-ভিত্তিক খ্যাতনামা মানবাধিকার সংস্থা রবার্ট এফ. কেনেডি’র ফেলো হিসেবেও কাজ করেছি। নেদারল্যান্ডস-এর খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটি অব অ্যামস্টারডাম-এ সংযুক্ত গবেষক হিসেবে আমি দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার গণতন্ত্র ও নাগরিক সমাজ নিয়ে গবেষণা করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে আমি ধর্ম ও গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করেছি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডাইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে এবং ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসন-এ শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খ্যাতনামা জার্নাল ও প্রকাশনা সংস্থা থেকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিষয়ে আমার রয়েছে ২০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নেতৃত্বে একটি গবেষণা টিম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি পরিমাপের একটি নতুন স্থানীয় সূচক উদ্ভাবন করে। এছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি ও লুটপাটতন্ত্র নিয়ে আমি দীর্ঘ দুই বছরের গবেষণা লব্ধ একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থ প্রকাশ করি। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আমি বিশ্বব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের কারিগরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির সহ-লেখক ছিলাম (প্রথমটি, ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের জন্য “ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি স্ট্র্যাটেজি” বা জাতীয় সততা ও নৈতিকতা কৌশলপত্র (পরবর্তীতে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ হিসেবে গৃহীত); এবং দ্বিতীয়টি, ২০১৩ সালে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় উপকারভোগী হিসেবে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার কৌশলপত্র)।

শিক্ষা ও কর্মের প্রয়োজনে আমি যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলংকা, ও নেদারল্যান্ডস-এ বসবাস করেছি এবং বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছি।

জুলাই আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপির সাথে সম্পৃক্ততা

জুলাই ২০২৪-এর রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে আমি সারা বিশ্বে অভ্যুত্থানের সপক্ষে জনমত তৈরি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের পক্ষে নিয়ে আসা এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও চাপ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। উল্লেখ্য, আমি ২০১৯ সাল থেকেই বাংলাদেশের তরুণ রাজনীতিকদের সাথে দেশের পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে আসছি। ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপির আমি একজন প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-আহ্বায়ক। বর্তমানে আমি দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দলের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও লিঁয়াজোতে নেতৃত্ব প্রদান করছি। এছাড়া আমি দলের নীতি ও গবেষণা সেল, শিক্ষা সেল, এবং দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করছি। জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপির ঐতিহাসিক ২৪-দফা ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন, দলের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লিটারেচার প্রণয়নে আমি অন্যতম ভূমিকা পালন করি।

লিখক;- সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া 
প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক ও 
বর্তমান আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক 
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।